৩ বল ২ রান: বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের এক চিরস্থায়ী আক্ষেপ!

গ্যালারী তখন “জিতেগা ভাই জিতেগা, ইন্ডিয়া জিতেগা” ধ্বনিতে উত্তাল।শেষ বল, শুভাগত হোম স্ট্রাইকে, ব্যাটে বলে হলোনা, ধোনির হাতে বল, দৌড়ে এসে ভেঙে দিলেন স্ট্যাম্প, মুস্তাফিজ তখনও ক্রিজ থেকে সেন্টিমিটার দূরে।ধ্বংসস্তূপ থেকে ম্যাচ বের করে নিয়ে গেলো ভারত,পুরো বাংলাদেশ নিস্তব্ধ,পাথর।

Obayedul Islam, Student, Department of Materials Science;

Technical University of Darmstadt, Germany.

২০১৫ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপে, ইংল্যান্ড এর বিপক্ষে খেলা, টানটান উত্তেজনা,বল করছেন রুবেল, ব্যাটিং এ ইংল্যান্ড এর শেষ ব্যাটসম্যান জেমস এন্ডারসন,জিতলে প্রথমবারের মত বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে বাংলাদেশ,কমেন্ট্রি বক্সে নাসের হোসাইন রুবেলকে বলছেন, ‘Don’t go for the yorker’, কারণ ব্যাট এর কোনায় লেগে চার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল, রুবেল দৌড় শুরু করলেন,বল করলেন, ইয়র্কার, বোল্ড।পুরো বাংলাদেশ আনন্দে উত্তাল।নাসের হোসাইন বলছেন, “The mighty Bangladesh tigers knock the England lions out.”


সেই শুরু,মাশরাফি বিন মুর্তজার নেতৃত্বে ওয়ানডে ফরম্যাট এ ঘরের মাটিতে দুর্ধর্ষ এক দল হয়ে উঠলো বাংলাদেশ। দলের সিনিয়ররা ফর্মের তুঙ্গে,সাথে যুক্ত হলেন একঝাঁক তরুণ প্রতিভা,এক এক করে বধ হলো ভারত,পাকিস্তান,দক্ষিণ আফ্রিকা। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল ধীরে ধীরে হয়ে উঠল সবার আস্থার প্রতীক। আমরা প্রতিটি জয়ে এক নতুন গর্ব অনুভব করতে শুরু করলাম, আমাদের হৃদয়ে বিশ্বাস জন্মানো শুরু হলো,—বাংলাদেশ ক্রিকেট বোধহয় এবার সত্যিই শক্তিশালী হয়ে উঠছে।২০১৬ সালে, যখন বাংলাদেশ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের জন্য ভারতীয় মাটিতে গেল,সবার মনে আশা, এবার হয়তো বড় কিছু ঘটবে। বাছাইপর্ব বেশ সহজেই উতরে গেল বাংলাদেশ।মূলপর্ব শুরু হল, ভারত বনাম বাংলাদেশ,ভরা গ্যালারি, নিউজিল্যান্ড এর কাছে আগের ম্যাচে হেরে ভারত তখন খাদের কিনারে। জিতলে পরের রাউন্ড প্রায় নিশ্চিত বাংলাদেশের।

আমার মনে আছে, আমি এই ম্যাচটি দেখার জন্য কতটা অপেক্ষা করছিলাম;সে কি উত্তেজনা। খেলা শুরু হলে আমার বাবা, যিনি ক্রিকেটের ব্যাপারে তেমন বুঝতেন না, তিনিও আমার উত্তেজনা দেখে খেলা দেখতে বসলেন।বাংলাদেশী বোলাররদের বেশ নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে ভারতের পুঁজি ১৫০ ও পার হলো না,জয়ের জন্য বাংলাদেশের দরকার ১৪৭। ভারতকে মাত্র ১৪৭ রানে আটকে দেওয়া, সে তো অলৌকিক কাণ্ড! তখন মনে হচ্ছিল, আমাদের জয় সুনিশ্চিত।বাংলাদেশের ব্যাটিং শুরু হল, তখন মনে হচ্ছিল, জয় আমাদের হাতের মুঠোয়। তামিম ইকবাল চমৎকার খেলছিলেন, সাকিব আল হাসান, সাব্বির রহমানও ভালই সঙ্গ দিচ্ছিলেন।শেষ ওভারে জিততে প্রয়োজন ১১, বোলিং প্রান্তে হার্দিক পান্ডিয়া, ক্রিজে বাংলাদেশের দুই অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান মুশফিক আর মাহমুদউল্লাহ।দুই বলে দুটো চার মেরে ম্যাচ টা হাতের নাগালে নিয়ে আসলেন মুশফিক।আমরা তখন উৎসব শুরু করে দিয়েছি, ভারতের মাটিতে ভারত বধ, এ তো কম বড় কথা নয়।নিস্তব্ধ গ্যালারি, পাণ্ডিয়া বল করতে আসলেন, শেষ ৩ বলে ২ রান দরকার- দুটো সিঙ্গেল নিলেই খেলা শেষ, মুশফিক সজোরে হাঁকালেন,টাইমিং হলো না, সীমানার কাছে ক্যাচ।

তখনও আমরা আশা ছাড়িনি,মাহমুদউল্লাহ তো আছেন,কিন্তু বিধি বাম!ফুলটস বল হাকাতে গিয়ে জাদেজার হাতে ধরা মাহমুদউল্লাহ।গ্যালারি তখন “জিতেগা ভাই জিতেগা, ইন্ডিয়া জিতেগা” ধ্বনিতে উত্তাল।শেষ বল, শুভাগত হোম স্ট্রাইকে, ব্যাটে বলে হলোনা, ধোনির হাতে বল, দৌড়ে এসে ভেঙে দিলেন স্ট্যাম্প, মুস্তাফিজ তখনও ক্রিজ থেকে সেন্টিমিটার দূরে।ধ্বংসস্তূপ থেকে ম্যাচ বের করে নিয়ে গেলো ভারত,পুরো বাংলাদেশ নিস্তব্ধ,পাথর।আমার স্পষ্ট মনে আছে,ওই রাতে একফোঁটা ঘুম ও আমার চোখে আসেনি। সেই তো শুরু, তারপর থেকে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল আমাদের কম আশাভঙ্গের বেদনায় পোড়ায় নি। কতবার রেগেমেগে বলেছি, আর কখনও বাংলাদেশের খেলা ভুলেও দেখব না, সেই আমি নিজেকে আবিষ্কার করি পরের খেলায় টিভি পর্দার সামনে।এত আবেগ,এত সমর্থনে সিক্ত আর কোনো দল কি আছে এই পৃথিবীতে? এখনো স্বপ্ন দেখি,হয় এই বিশ্বকাপ,নাহয় পরের বিশ্বকাপ, হয়তোবা এর পরের বিশ্বকাপ, টাইগারদের হাতে ট্রফি উঠবে,লাল সবুজ পতাকা নিয়ে পুরো মাঠ প্রদক্ষিণ করবে, টিভি অথবা ফোনের সামনে এই দৃশ্য দেখে আমার আনন্দে বুক ভাসাব।তখন আমরা ভুলে যাবো সেই মার্চ ২৩,২০১৬ তারিখটা।

দিনশেষে বাংলাদেশী মানুষের কাছে ক্রিকেটটা নিছক খেলার গণ্ডি ছাপিয়ে চলে গেছে বহুদূর, হয়ে উঠেছে জীবনের অংশ।বাংলাদেশ ধীরে ধীরে তরুণদের নেতৃত্বে উন্নতি করছে,এই ধারা অব্যাহত থাকুক,বিশ্বমঞ্চে টাইগাররা আবির্ভূত হোক পরাশক্তি হিসেবে, ক্রিকেটের এক ভক্ত হিসেবে এইটাই আমার চাওয়া। শেষ করি এইটা বলে,
“Cricket Is Life… Everything Else Is Just a game.”

***The opinions shared in this article are the author’s own and do not represent this platform’s stance.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *