সভ্যতা ও মানবতার এক শাশ্বত রূপকথা “কালান্তর”

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সাহিত্যের মানচিত্রে এমন কিছু লেখনী সৃষ্টি করেছেন যা শুধু সাহিত্যের চৌকাঠেই আবদ্ধ নয়, বরং সময়, সমাজ ও সভ্যতার গভীরে প্রবেশ করে আমাদের আত্মার স্পন্দনে নাড়া দেয়। ১৯২৮ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ কালান্তর সেই রকমই এক অনন্য সৃষ্টি। এটি একদিকে তৎকালীন সমাজের আয়না, অন্যদিকে ভবিষ্যতের জন্য এক মূল্যবান পথনির্দেশ।

কালান্তর শুধুমাত্র সময়ের পরিবর্তন নিয়ে লেখা নয়; এটি সময়, সভ্যতা এবং মানবতার গভীর সংযোগের কথা বলে। এখানে কবি প্রশ্ন করেছেন, “আমরা সভ্যতা গড়ছি, কিন্তু তা কি মানবতাকে বাঁচিয়ে রেখে?” আধুনিক সভ্যতার জটিল যন্ত্র ও প্রযুক্তি আমাদের জীবনের বাহ্যিক রূপ পাল্টাচ্ছে, কিন্তু আমাদের অন্তর কি সেই রূপান্তরের সাথে তাল মিলিয়ে এগোচ্ছে? রবীন্দ্রনাথের এই প্রশ্নগুলো আজও সমান প্রাসঙ্গিক। তিনি দেখিয়েছেন, “সময়ের পরিবর্তন প্রকৃতির নিয়ম, কিন্তু সেই পরিবর্তনের ভিতরে যদি মানবিকতার আলো না থাকে, তবে তা কেবল ক্ষণস্থায়ী বুদবুদের মতো।” এই দর্শন থেকেই তিনি সময়ের সাথে মানুষের দায়বদ্ধতার বিষয়টি গভীরভাবে তুলে ধরেছেন।

কালান্তর এর অন্যতম আকর্ষণীয় অংশ হলো সভ্যতার সংকট, যেখানে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক যুগের যান্ত্রিকতাকে সমালোচনা করেছেন। তাঁর মতে, সভ্যতার অগ্রগতির মাপকাঠি শুধু প্রযুক্তি বা বস্তুগত সাফল্য নয়; এর আসল মানদণ্ড হলো মানুষের অন্তরের বিকাশ। তিনি বলেন, “মানুষ যদি তার আত্মিক সত্যকে বিসর্জন দেয়, তবে সমস্ত উন্নতিই বৃথা।” কবি স্পষ্ট করেছেন যে, পাশ্চাত্য সভ্যতার অন্ধ অনুকরণ আমাদের নিজের সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধকে বিপন্ন করেছে। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, প্রকৃত উন্নয়ন তখনই সম্ভব, যখন আমরা আমাদের শিকড় ভুলে না যাই।

রবীন্দ্রনাথের চিন্তাধারার একটি বিশেষ দিক হলো তাঁর জাতীয়তাবাদ ও বিশ্বমানবতার মধ্যে ভারসাম্যের আহ্বান। তিনি বলেছেন, “জাতীয়তাবাদ যদি সংকীর্ণ হয়ে ওঠে, তবে তা মানবতাকে বিভক্ত করে।” তাঁর কাছে মানবতাই সর্বোচ্চ এবং এর চেয়ে বড় কোনো পরিচয় নেই। এক্ষেত্রে তিনি কেবল সমালোচকই নন, বরং দিশারী। তিনি দেখিয়েছেন, কিভাবে জাতিগত সীমানা পেরিয়ে বিশ্বমানবতার আলোকসন্ধান করা যায়। এই ধারণা আজকের বৈশ্বিক বিশ্বায়নের যুগেও আমাদের কাছে সমান গুরুত্ব বহন করে।

গ্রন্থের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো বিজ্ঞান ও প্রকৃতির ওপর রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে স্বাগত জানিয়েছেন, কিন্তু বলেছেন, “যেখানে বিজ্ঞান মানুষের অন্তরের সৌন্দর্য এবং প্রকৃতির সাথে সংযোগ হারিয়ে ফেলে, সেখানে তা ধ্বংস ডেকে আনে।” রবীন্দ্রনাথের এই পর্যবেক্ষণ আজকের সময়ের জন্য এক অনন্য দিকনির্দেশনা। জলবায়ু পরিবর্তন, প্রকৃতির উপর অত্যাচার এবং মানুষের আত্মিক বিচ্ছিন্নতার যুগে তাঁর এই কথা যেন ভবিষ্যতের প্রতি এক সতর্ক সংকেত।

কালান্তর গ্রন্থটি এক অদ্ভুত মায়াবী শক্তি নিয়ে পাঠকের সামনে আসে। এর ভাষা সহজ, অথচ এর ভাবনা এত গভীর যে তা মনকে আন্দোলিত করে। রবীন্দ্রনাথের লেখনীতে কবিতা এবং দার্শনিকতার এমন মেলবন্ধন ঘটেছে, যা একইসঙ্গে হৃদয়কে স্পর্শ করে এবং মস্তিষ্ককে নতুন চিন্তার দিকে আহ্বান জানায়। তাঁর প্রতিটি বাক্যে রয়েছে এক সঙ্গীতময়তা, যা পাঠককে শুধু ভাবায় না, বরং আত্মার অন্তর্গত স্তরে প্রবেশ করে। কবির কথায়, “মানুষের চিরন্তন সত্যই তাকে বাঁচিয়ে রাখে।” কালান্তর সেই চিরন্তন সত্যের সঙ্গীত, যা আমাদের স্বর, আমাদের অন্তর এবং আমাদের সময়ের জন্য অমোঘ শিক্ষা।

***The opinions shared in this article are the author’s own and do not represent this platform’s stance.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *