বইয়ের দোকান পরখ করলেই বেবাক সমাজটা কোনদিকে যাইতাছে, হেইডা টের পাওন যায়।

আবদুর রাজ্জাক সারা জীবন কিছু লেখেন নি। তার কারণ অনুসন্ধানে লেখকের নিকট যা প্রস্ফুটিত হয়েছে তার সারাংশ হল যৌবনে যে মানুষ ট্রটস্কির থিওরি অফ পার্মানেন্ট রেভুলেশনের বাংলা ও অবন ঠাকুরের “বাংলার ব্রত” এর ইংরেজায়ন করেছেন  সেই মানুষের পক্ষে কোন মামুলি বিষয়ে কাজ করা, নামান্তরে মানসিক সূক্ষ্মচার সমুন্নত স্তর থেকে নিচে নেমে আসা। যা তার পক্ষে অসম্ভব রকম দূরহ ছিল।

জার্জিস খান , শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়;

জাতীয় অধ্যাপক, নিভৃতচারী, অনাড়ম্বর জ্ঞান সাধক। নাম তার আবদুর রাজ্জাক। যদ্যপি আমার গুরু আহমদ ছফা কর্তৃক লিখিত সেই মানুষ ও মনীষী সম্পর্কে ধারণা তৈরি করতে এক অনবদ্য সুখপাঠ্য গ্রন্থ। 

শতের মাত্রা ছাড়িয়ে আরো গোটা দশেক পৃষ্ঠা জুড়ে ব্যাপিত এবং ষোলোটি ভাগে বিন্যস্ত এই বইটি যেন আব্দুর রাজ্জাকের খোলামেলা, তীক্ষ্ণ, গভীর ও সরস আলোচনায় উপস্থিত সুষম উপাদানের মতোই জ্ঞানের ষোল কলা পূর্ণ করেছে।

জ্ঞানতাপস আবদুর রাজ্জাককে নিয়ে বইটি লিখেছেন তারাই সুযোগ্য ছাত্র আহমদ ছফা।যিনি খুব ঘনিষ্ঠভাবে তার শিক্ষককে দেখার দুর্লভ সৌভাগ্যমন্ডিত । বইটি লেখার ক্ষেত্রে তিনি আব্দুর রাজ্জাকের উচ্চারিত বাক্যের প্রতিধ্বনি করেছেন বা তার পাশাপাশি যে শুধু ব্যাখ্যা উপযুক্ত পরিপ্রেক্ষিত স্থাপন করেছেন তা নয়, বরং প্রয়োজনে প্রতিবাদও করেছেন। 

বইটির প্রথম ভাগে লেখক যে প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করে তার সাথে আব্দুর রাজ্জাকের সাক্ষাৎ ঘটতে যাচ্ছিল তার বর্ণনা তুলে এনেছেন। 

দ্বিতীয় ভাগের শুরুটা ইন্টারভেলের পরে চমক নিয়ে শুরু হয় চলচ্চিত্রের মতোই। যা আব্দুর রাজ্জাকের ঢাকাইয়া বুলিতে লেখকের সাথে নাটকীয় প্রথম সংলাপের চমকপ্রদ বয়ান।এবং যেখান হতে আহমদ ছফা তার নামের পূর্বে মৌলভী নামক এক চরিত্রও বয়ে নিয়ে চলেন পরের বছরগুলোতে। 

প্রথমভাগে লেখক এর কাজের বিষয়বস্তুর সংক্ষিপ্ত নামধাম থাকলেও এখানে এসে তার একটা কিতাবি নাম পাওয়া যায়। দ্যা গ্রোথ অফ মিডিল ক্লাস ইন বেঙ্গল এস ইট ইনফ্লুয়েনসড ইটস লিটারেচার, সোসাইটি এন্ড ইকোনোমিকস ফ্রম এইট্টিনথ টু এইট্টিনথ ফিফটি এইট।

ব্যক্তি আব্দুর রাজ্জাকের স্নেহবাৎসল্য, মানুষের সাথে মিশতে পারা, আতিথিপরায়ণতারও একটা ফর্ম আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় এই পর্বে এবং তৎপরবর্তী ভাগে।

পাশাপাশি তৃতীয় ভাগে কবি জসীম উদ্দীনের কবিসুলভ আচরণের বর্ণনা হয়ে কাজী নজরুল ইসলাম, কাননবালা, ওস্তাদ জমিরুদ্দিন এর উল্লেখও দেখা যায়। 

বইয়ের চতুর্থ ভাগে চার কোণা দাবা বোর্ড নিয়ে মশগুল আব্দুর রাজ্জাক আর গ্র্যান্ড মাস্টার নিয়াজ মোর্শেদকে দাবা খেলার টেকনিক, ফন্দি ফিকির নিয়ে গভীর আলাপে ব্যস্ত দেখা যায়। 

আবার সেই আব্দুর রাজ্জাকই আহমদ ছফাকে পড়াশোনার কুল কিনারার দিশা দিতে গিয়ে মিস্টার হ্যারোল্ড লাস্কির বচন চয়ন করছেন, মাই বয়,গো এ্যান্ড সোক।

ধারাবাহিকভাবে পঞ্চম ভাগে গিয়ে আবদুর রাজ্জাককে পঞ্চপাণ্ডবের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা যায়। আহমদ ছফার মূলত আব্দুর রাজ্জাক মুখীতার কারণ ছিল তার থিসিসের যুগপৎ ব্যবস্থা সাধন। সেই মাঠে অগ্রসরতার হালচালের সুলুক সন্ধানে নেমে আব্দুর রাজ্জাক যখন জানতে পারেন যে ছফা বি.বি মিশ্রের ইন্ডিয়ান মিডল ক্লাসেস, উইলিয়াম হান্টারের এ্যানালস অফ রুরাল বেঙ্গল সমেত আরো কিছু বই পড়েছেন, পড়ছেন কিন্তু দরকারি অংশ নোট রাখেননি , তখন তার অভিব্যাক্তি ছিল ক্ষেত চাষবার সময় জমির আইল বেঁধে রাখতে হয়। 

আবদুর রাজ্জাক সারা জীবন কিছু লেখেন নি। তার কারণ অনুসন্ধানে লেখকের নিকট যা প্রস্ফুটিত হয়েছে তার সারাংশ হল যৌবনে যে মানুষ ট্রটস্কির থিওরি অফ পার্মানেন্ট রেভুলেশনের বাংলা ও অবন ঠাকুরের “বাংলার ব্রত” এর ইংরেজায়ন করেছেন  সেই মানুষের পক্ষে কোন মামুলি বিষয়ে কাজ করা, নামান্তরে মানসিক সূক্ষ্মচার সমুন্নত স্তর থেকে নিচে নেমে আসা। যা তার পক্ষে অসম্ভব রকম দূরহ ছিল। 

ক্রমান্বয়ে ষষ্ঠ ধাপে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের ধী শক্তি বৃদ্ধির চলমান প্রক্রিয়া কারো আড়ালে থাকবার কথা নয়।যেখানে টয়েনবির ইন্ড্রাস্টিয়াল রেভ্যুলেশন বইটা পাঠ করার পর ছফার মনে হতে থাকে গতকালের সে হতে আজকের সে অনেক পরিবর্তিত।চিন্তার জগতে প্রভাব বিস্তার করার এমন অপরিসীম ক্ষমতা, যা ভাবান্তর ঘটায়, যদি দ্বিতীয় কোন বইকে দেওয়া যায় তার নাম হবে কন্ডিশন অফ দা ওয়ার্কিং ক্লাস ইন ইংল্যান্ড, ফ্রেডরিক এঙ্গেলস প্রণীত।

সুর মিলানোর যে সুযোগ প্রাপ্তির কথা গৌড়চন্দ্রিকায় বলা হচ্ছিল তা এবার সাত সমুদ্রের পাড়ে সাত তম পর্বে  পাওয়া যাবে। 

ফিউডালিজম সম্পর্কে আব্দুর রাজ্জাক বলছেন, উহা একটি ক্লোজড সিস্টেম। আর বেঙ্গলের সমাজের ন্যাচারে পুথি ঘেঁটে দেখা যায় যে বাংলার বাণিজ্য বহর জাভা  সুমাত্রা এই সকল অঞ্চলে আসা-যাওয়া করছে।

সুতরাং বাংলায় এক্কেরেই সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ছিল না ।

অথচ সামন্তবাদে যে সমুদ্র বাণিজ্য থাকবে না এমন কোন তত্ত্ব আমরা তালাশ করেও কোনো হদিস পাই না।তাই অবশ্যই বিষয়টি প্রশ্নের দাবী রাখে। 

ঘটনার অববাহিকার স্রোত পেরিয়ে আমরা অষ্টম ভাগে পৌঁছলে অষ্টধাতুর মতোই কিছু মূল্যবান জ্ঞানালাপ খুঁজে পাই। 

আব্দুর রাজ্জাকের ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের সমর্থন প্রসঙ্গ সামনে আসলে তিনি তার প্রকৃত অবস্থা ব্যক্ত করেন। আধুনিক সোশ্যাল ডিসকোর্স হিসেবে উপন্যাসের পানে চোখ মেললেই দেখা যায় হিন্দু লেখকেরা বাংলার বায়ু, বাংলার জল এসব ভালো করে বললেও ডেলিবারেটলি  মুসলমান সমাজ ও সংস্কৃতিকে ইগনোর করা, তাদের রাইটফুল রিপ্রেজেন্টেশনের অধিকার হতে বঞ্চিত করা।এহেন স্টাবর্ন এটিটিউড প্রদর্শনের বিপরীতে অন্য কোন পন্থা না থাকাই তার পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার কারণ।

নয় সূচক নবরত্ন রুপক পর্যায়ে আহমদ ছফা  বাংলার চিত্রশিল্প জগতের এক রত্নের সাথেই আব্দুর রাজ্জাকের সম্পর্কের বিবরণ বিবৃত করেন। তিনি এস.এম সুলতান। যিনি ইউরোপের সমাজেও বেশ সমাদৃত হয়েছেন তৎকালের জগতখ্যাত চিত্র শিল্পীদের কাতারে দাঁড়িয়েই(বাঙালি মুসলমানের মন, ভূমিকা অংশ দ্রষ্টব্য)। সুলতানকে তুলে আনার পেছনে আহমদ সফর অবদান অনস্বীকার্য ।যার প্রমাণ সুলতানের চিত্রকর্মের উপর “বাংলার চিত্রঐতিহ্য ও সুলতানের সাধারণ” নামক পঞ্চাশ পৃষ্ঠার প্রবন্ধ থেকেই জানা যায়।

পর্বগুলো দশমে পৌঁছলে স্বাভাবিকভাবেই এক ভিন্নতার যাত্রা লক্ষ্য করা যায়। সালমান রুশদির নভেল মিডনাইট চিলড্রেন্স পড়ে আবদুর রাজ্জাক তখন বেশ উচ্ছ্বসিত। ইংরেজি ভাষার ইডয়মের ব্যবহারিক পদ্ধতিই যেখানে পাল্টে ফেলতে দেখা যায়।

এগার তম ভাগে কিছু সম্বল পাওয়া যায়। বেঙ্গলের জন্য সবচাইতে মিসফরচুন ব্যাপার এখানে সাপোর্টিং কলেজ হওয়ার আগে ইউনিভার্সিটি এবং মিডল স্কুল হওয়ার আগে কলেজ হইছে। তথা শুরু থেকেই সিস্টেমটা টপ হেভি, যা স্বভাবতই ডিগ্রি ক্রেজিনেস তৈয়ার করে।

বারো তম পর্বে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীত ইতিহাস হতে কিছু উজ্জ্বল নক্ষত্রের আলো পাওয়া যায়। ফিজিক্সের সত্যেন বসু হয়ে একে একে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, মোহিতলাল মজুমদার, সুশীল কুমার উত্তর অমীয় দাশগুপ্ত। এদের পদচারণায় জ্ঞানের প্রাঙ্গণ প্রাণচঞ্চল হয়ে ওঠে। 

তেরো পার্বনের পর্বে হ্যারল্ড লাস্কির সঙ্গে আবদুর রাজ্জাকের কাটানো পাঁচ বছর সাহচর্যের গল্প পাই।

চোদ্দতম পর্বে সেক্যুলারিজম প্রশ্ন নিয়ে বেশ ভারসাম্যপূর্ণভাবেই উপস্থাপন করতে দেখা যাবে পন্ডিতকে। এবং যার যথার্থতা “Secularisation effect of Islam on India was really enormous” বক্তব্যে ফুটে ওঠে। 

পঞ্চদশ পরিচ্ছদের আবর্তনা হয় এক বেদনাবিধূর মাধ্যমে। পণ্ডিত সিঙ্গাপুর থেকে চিকিৎসা করে এসেছেন এবং তখন থেকেই তার মধ্যে কথা বলা সহ বিবিধ ক্ষেত্রে নতুন প্রবণতা লক্ষিত হয়। আরো আগে কথা বলতে যে উইট ঠিকরে বেরিয়ে আসতো তখন তার অনুপস্থিতি পরিদৃশ্যমান। যেন স্মৃতির ভান্ডে জমা কথা সব উজাড় করে দিতে পারলেই বেঁচে যান।

সমাপণী ভাগে তিনি বাঙালি মুসলমান সমাজের জন্য তার কিছু অমীয় বাণী রেখে গেছেন । সেকুলারিজম বিকাশের প্রক্রিয়াটি সমাজের ভেতর থেকে, বাঙালি মুসলমানের সামাজিক অভিজ্ঞতার স্তর থেকে বিকশিত করতে হবে।

কবি বলে গেছেন, নক্ষত্রেরও পতন হয়। 

এমন দাবি জানিয়েই তিনি নক্ষত্রের মতো কোনো আড়ালে চলে যান।

***The opinions shared in this article are the author’s own and do not represent this platform’s stance.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *