চাচা কাহিনী: বাঙালির অফুরান আড্ডা আর হাস্যরসের এক অনবদ্য উপাখ্যান।

তবে পরেরদিন যখন পণ্ডিতমশাই লেখককে জিজ্ঞেস করেন, লাটের তিন পা ওয়ালা কুকুরের জন্য খরচ পঁচাত্তর টাকা,আর পণ্ডিতমশাই এবং তার আটজনের পরিবার চালাতে পাওয়া মাইনে ২৫ টাকা হলে “বল তো দেখি,… এই ব্রাহ্মণ পরিবার লাটসায়েবের কুকুরের কটা ঠ্যাঙ এর সমান?” তখন আমরা জবাব দিতে পারিনা।

তানবীর মুহাম্মদ জুলকারনাইন, শিক্ষার্থী,আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ;
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

১৯২৯, বার্লিনের উলান্ডস্ট্রাসের উপর ‘গরীব ভারতীয়’ দের আপন রেস্তোরাঁ ‘হিন্দুস্তান হৌস’ এর পত্তন হল।আড্ডাবাজ বাঙালি বার্লিনের মত জায়গাতেও জমাটি আড্ডা বসার বন্দোবস্ত করে ফেলল।জর্মন অজর্মন সকলের জন্য সরাইখানার দ্বার খোলা। আড্ডা চক্রের নিয়মিত সদস্যদের মধ্যে আছেন গোস্বামী ওরফে গোঁসাই, ভাষাবিশারদ রায়সাহেব, চ্যাংড়া লেডি কিলার পুলিন সরকার,ঔপনিবেশিক বাঙালি শ্রীধর মুখুজ্যে, আর সদা গলাবন্ধ কোটধারী আড্ডার চক্রবর্তী জর্মন পন্ডিত, বিদ্যার জাহাজ চাচা।এই চাচা আর চাচার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে ১১ টি গল্পে সাজানো মুজতবা আলীর এক অনবদ্য গ্রন্থ “চাচা কাহিনী”।

কে এই চাচা? প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর মৃতপ্রায় বার্লিন যখন অর্থ আর জনবলের অভাবে ধুঁকছে, ভারতেও যখন উপনিবেশবাদী আন্দোলন তুঙ্গে উঠেছে, তখন ভাগ্য ফেরানোর আশায় বাঙাল মুলুক থেকে কিছু তরুণ পাড়ি জমান বার্লিনে, ঐখানেই থিতু হন তাঁরা, জীবিকার তাগিদে।চাচা সেই বাঙালদের একজন। কী কঠোর পরিশ্রম করেই না তারা বার্লিনে ধীরে ধীরে নিজেদের প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন, চাচা কাহিনীর পরতে পরতে তা লুকিয়ে আছে।প্রথম গল্প স্বয়ংবরা তেই এর প্রমাণ মেলে। তবে মুজতবা আলীর আসল ওস্তাদি স্পষ্ট হয় “কর্নেল” গল্পে। প্রাশানদের জাত্যাভিমান,দেশপ্রেমের কী করুন কাহিনীই না মুজতবা বুনন করেছেন চাচার বয়ানে। অসম্ভব অভিজাত, বর্তমানে রিক্ত তবে আত্মমর্যাদায় বলীয়ান প্রাশান কর্নেলের বাড়িতে পেয়িং গেস্ট হিসেবে চাচার দিনযাপন, “প্রাশান কলচর” এর সাথে পরিচয়,কর্নেল ফ্রাউ ডুটেনহোফার এর কাছে গেটে পাঠ,শেষে এক বেদনাবিধুর সমাপ্তি আমাদের আর্দ্র করে দেয়। কর্নেলের প্রাশান আভিজাত্য,রক্তসংমিশ্রনের ফলে নিজের কন্যাকে ত্যাগ - জাতি এবং জাতি রাষ্ট্র নিয়ে আমাদের আরেকবার ভাবতে বাধ্য করে। 

মা- জননী গল্পে আমরা যেমন চিরায়ত অকৃত্রিম মাতৃস্নেহ দেখতে পাই,তেমনি সমাজে একা এক নারীর অসহায়ত্বও মনে দাগ কাটে।ঠিক তেমনি আরেক নারীকে দেখতে পাই পুনশ্চ গল্পের প্যারিস এর রাস্তায়।জার্মান সর্দি কাশি নিয়ে হাস্যরসে পরিপূর্ণ গল্প “বেঁচে থাক সর্দি কাশি”- ও অসাধারণ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে ঠিক কোন প্রেক্ষাপটে নাৎসিদের উত্থান হওয়ার কেনইবা জার্মানরা এদের স্বাগত জানালো,ঠিক সেই সময়কার জার্মান মানসিকতা বুঝতে চাইলে পড়তে হবে “বেলতলাতে দু – দুবার” গল্পটি। পাঁড় নাৎসি অস্কার এর সাথে চাচার অদ্ভুত সম্পর্ক এই গল্পের উপজীব্য। পার্সিদের মৃত সৎকার নিয়ে এক চমৎকার গল্প “রাক্ষসী”,গভীর রসিকতায় ফুটিয়ে তোলে ক্রুর সত্য।

এই বাঙাল মুলুকে শিক্ষাগুরুদের দুর্দশা নিয়ে লেখা পাদটীকা গল্পটি এখনো পুরোদমে প্রাসঙ্গিক। ইংরেজি শিক্ষার জয়জয়কার চারিদিকে, যেসব সংস্কৃত পণ্ডিতেরা নিষ্ঠার সাথে ভারতীয় সংস্কৃতি চর্চা করে গেছেন,তাদের টোলগুলো বন্ধ হওয়ার উপক্রম, অনেকে চাকরি নিলেন চাপরাশির চেয়েও কম মাইনে নিয়ে হাইস্কুলে। কী নিতান্ত সহজ সাধারণ অভাব পীড়িত জীবন তাদের।সুরমার তীরে সিলেট সরকারি পাইলট স্কুল, যেটা মুজতবা এবং এই নিবন্ধের লেখকের বিদ্যাপীঠ,সেই বিদ্যাপীঠের এরকম এক পন্ডিতের ইংরেজ বড়বাবু আসা উপলক্ষে আনকোরা নতুন হলদে গেঞ্জি পরা আর অনভ্যাসে ছটফট করতে থাকা, আর বড়বাবুর সামান্য “Hello Pundit” শুনে বিগলিত হয়ে বারবার ঝুঁকে ঝুঁকে সায়েবকে সেলাম দেওয়া পাঠককে বিষন্ন করে। তবে পরেরদিন যখন পণ্ডিতমশাই লেখককে জিজ্ঞেস করেন, লাটের তিন পাওয়ালা কুকুরের জন্য খরচ পঁচাত্তর টাকা,আর পণ্ডিতমশাই এবং তার আটজনের পরিবার চালাতে পাওয়া মাইনে ২৫ টাকা হলে “বল তো দেখি,… এই ব্রাহ্মণ পরিবার লাটসায়েবের কুকুরের কটা ঠ্যাঙ এর সমান?” তখন আমরা জবাব দিতে পারিনা।

সবকিছু মিলিয়ে হাস্যরসের আড়ালে গভীর জীবনবোধ লুকিয়ে আছে চাচা কাহিনীর প্রতি কোণায়। হিন্দুস্তান হৌস এর আড্ডায় মশগুল হয়ে মনে হয় আমরা নিজেই হয়তো বসে আছি সেই সরাইখানায়।বিয়ারের নেশায় বুঁদ সুয্যি রায়, কিংবা গোলাম মৌলা- সবাই যেন আমাদের বহুদিনের চেনা।এইতো মুজতবা আলী, এভাবেই লেখেন উনি,তাইতো এত অনায়াসে হাসির আড়ালে লুকিয়ে ফেলেন করুন কান্না, দেখিয়ে দেন গভীর জীবন বোধ। মুজতবা আলীর লেখা প্রকৃত অর্থেই উচ্চমার্গীয়(বেল লেত্রে)। চাচা কাহিনী – ই তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

***The opinions shared in this article are the author’s own and do not represent this platform’s stance.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *