দ্বিতীয় ‘আরব বসন্ত’ বা গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠাঃ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কী?

স্বৈরাচারের পতন ও গণঅভ্যুত্থান এর ফল সবসময় গণতন্ত্র নিশ্চিত করে না; আরব বসন্তের দেশ গুলোই তার প্রমাণ। বাংলাদেশও কি বিদেশী শক্তির দাবার ঘুঁটি তে রূপ নিবে, নাকি দেখা পাবে আসল গণতন্ত্রের? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা এখন সবথেকে জরুরি।

Geosurge Canvas

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’ নিয়ে বই-পুস্তক কিংবা বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে সমূহ আলোচনা লক্ষ্য করা গেলেও একুশ শতকের  সম্ভবত সবেচেয়ে বড় ‘ বিপ্লব ‘, যাকে ‘আরব বিপ্লব’ বা ‘ আরব বসন্ত ‘ নামে মানুষ চেনে , তা নিয়ে আলোচনার আকাঙ্ক্ষা বা ক্ষেত্র দুটিই সংকুচিত । এর কারণ হয়তো ঠান্ডাযুদ্ধের ডান-বামের আদর্শিক লড়াই। মানুষের ধারণা এই লড়াই এখনো চলমান এবং ভবিষ্যতে বিভিন্ন দেশের চলমান রাজনৈতিক ধারা ও কাঠামোতে এই ঠান্ডাযুদ্ধোত্তর অদৃশ্য আদর্শিক লড়াই বড় ভূমিকা রাখতে পারে।  তবে দক্ষিণ এশিয়ার চিত্র ভিন্ন। আদর্শিক লড়াই ছাপিয়ে এ লড়াই খোদ রাষ্ট্রপ্রধান ও রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে।  বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে আরব বসন্তের প্রাথমিক কারণ ও প্রাথমিক ফলাফলের 

( স্বৈরাচারের পতন ) সাথে  মিল রেখে বিপ্লবের নতুন দ্বার  দেরিতে হলেও উন্মোচিত হয়েছে। সেজন্যই আরব বিপ্লবের প্রেক্ষাপট এবং চূড়ান্ত পরিণতি বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য এখন আলোচনার সর্বাধিক সময়োপযোগী ও একই সাথে শিক্ষণীয়  বিষয় বলে পরিগণিত হতে পারে।  

৬ জুলাই,২০২৪; কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে শুরু হওয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতাত্তোর  ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনটি ছাত্রজনতা নির্বিশেষে গণমানুষের আন্দোলনে রূপ নিয়ে, পাঁচ শতাধিক প্রাণের তাজা রক্তে ভেসে ৫ আগস্ট ২০২৪, সরকারের পতনের মাধ্যমে পূর্ণতা পায়। ছাত্রসমাজের যৌক্তিক আন্দোলনকে নানাভাবে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করা হয় বিস্তর। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পেটোয়া বাহিনী দিয়ে রক্তাক্ত করা হয়।

কিন্ত ছাত্রসমাজ পিছু হটেনি। পুলিশ এর গুলির সামনে বুক পেতে দেওয়া আবু সাঈদ  এর আত্মা যেন বাসা বাঁধে সবার বুকে। মৃত্যুর মিছিলে শামিল হয় মুগ্ধ-ফারহানের মতো সাধারণ ছাত্ররা। ‘ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ এর ব্যানারে পরিচালিত এই সফল আন্দোলনের  সমন্বয়করা  নয় দফা দাবি পেশ করেন। কোটা সংস্কার হয় ঠিকই,কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে নয় দফা নিয়ে কোনো সদুত্তর আসে নি। 

মৃত্যুমিছিল অব্যাহত থাকে। অবশেষে ৩রা আগস্ট আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ঢাকা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে লক্ষাধিক মানুষের সমাবেশে এক দফা এক দাবি- সরকারের পতন ঘোষণা করেন।  ৫ই আগস্ট ‘,দফা এক দাবি এক ‘ – লংমার্চ এ ঢাকায় শামিল হন কোটি মানুষ, পতন হয় সরকারের । 

ছাত্রদের এই আন্দোলন অতি দ্রুত কিভাবে জনতার আন্দোলন হয়ে উঠল – এর কারণ মূলত দুটি। প্রথম কারণটি  অবশ্যই অর্থনৈতিক।  হাজার-কোটি টাকা পাচার, রিজার্ভ সংকট, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, খেলাপি ঋণ, সমাজে ধনী গরিবের চূড়ান্ত বৈষম্য মানুষ আর মেনে নিতে পারেনি। দ্বিতীয় কারণটি হলো এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল না কোনো রাজনৈতিক দল,সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক ছাত্রসমাজের আন্দোলনে তাই সহজেই মানুষ একাত্ম হতে পেরেছে।  এই বিপ্লব তাই প্রকৃত অর্থেই ছাত্রজনতার বিপ্লব।

স্বৈরাচারের পতন ও গণঅভ্যুত্থান এর ফল সবসময় গণতন্ত্র নিশ্চিত করে না; আরব বসন্তের দেশ গুলোই তার প্রমাণ। বাংলাদেশও কি বিদেশী শক্তির দাবার ঘুঁটি তে রূপ নিবে, নাকি দেখা পাবে আসল গণতন্ত্রের? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা এখন সবথেকে জরুরি। এজন্য প্রয়োজন আরব বসন্তের প্রেক্ষাপট এবং প্রাথমিকভাবে অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধানের পতনের পরও  চূড়ান্ত সফলতা না আসার কারণ পর্যালোচনা এবং বাংলাদেশের বিদ্যমান পরিস্থিতির সাথে তুলনামূলক বিশ্লেষণ। 

তিউনিশিয়ার অধিবাসী মো. বুয়াজিজির নিজ শরীরে অগ্নিসংযোগ ও সপ্তাহান্তে মৃত্যুর পর এই আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে।  শিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও তিউনিশিয়ার তৎকালীন অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধান বেন আলীর শাসনামলের অস্বাভাবিক রকমের দুঃশাসন, দুর্নীতি ও বেকারত্বের বেড়াজালে চাকরি হয়নি তার। পরে একটি ভাসমান ফলের দোকান নিয়ে রাস্তায় বসলে নানাবিধ অভিযোগ এনে তার ভাসমান দোকান জব্দ করা হয়। অনেক জায়গায় ঘুরে ঘুরেও সে ন্যায়বিচার পায়নি , এমনকি একজন নারী পুলিশ অফিসার কর্তৃক অপদস্থ ও লাঞ্ছনার শিকার হন তিনি। এরপর বেন আলী সরকারের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ নিজের শরীরে আগুন দেন তিনি। মুহুর্তেই দাবানলের মতো তিউনিশিয়ার জনসাধারণের মনস্তত্ত্বে এই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ক্রমেই এই আন্দোলন বেন আলীর পতনের চূড়ান্ত গণআন্দোলনে রূপ নেয়। ফলশ্রুতিতে ২০১১ সালে বেন আলীর পতন হয়। তবে এখানেই থেমে থাকেনি এই বিপ্লব । ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে মিশর, লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন , বাহরাইন , কুয়েত , ওমান, জর্ডান ও ইরাকসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশে।

বিপ্লব দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়লেও এবং বেশিরভাগ রাষ্ট্রে এই বিপ্লবের প্রাথমিক লক্ষ্য (অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধান বা রাজতন্ত্রের পতন )  পূরণ হলেও, যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার হাহাকারে এই আন্দোলন , তা আংশিকভাবে তিউনিশিয়া ছাড়া আর কোথাও প্রতিষ্ঠিত  হয়নি।  মিশর থেকে হোসনি মোবারক, লিবিয়া থেকে গাদ্দাফি , সিরিয়া থেকে বাশার আল আসাদ , ইয়েমেন থেকে আলী আব্দুল্লাহ সালেহ’র মতো স্বৈরশাসকদের সরালেও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা তো হয়ই নি বরং ক্ষেত্রবিশেষে কিছু কিছু দেশে শিয়া-সুন্নি গৃহযুদ্ধ বা চরমপন্থীদের উপদ্রব ব্যপকভাবে বেড়ে যায় । অথবা এক স্বৈরশাসকের জায়গায় আরেক স্বৈরশাসক প্রতিস্থাপিত হয় মাত্র । যেমনঃ মিশরে হোসনি মোবারক এর বদলে আবদেল ফাতেহ আল সিসি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। ইরাকে এখন ছলছে বাশার আল আসাদ এর শাসন। বিখ্যাত আমেরিকান লেখক ক্লি সাইমন এর মতো বিশ্লেষকরা তাই এই আন্দোলনের ফলাফলকে ‘হতাশাজনক’  হিসেবে তাদের লেখায় উল্লেখ করেছেন ।  

Ten years after the mass popular uprising known as the Arab Spring began in January of 2011, optimism can be hard to find.’ 

  • Clea Simon ( 10 years later: Was the Arab Spring a failure? – The Harvard Gazette )

মূলকথা , যার পতন হয় কিংবা পতন পরবর্তী যেই ক্ষমতা গ্রহণ করুক না কেন ,  গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরাচারের পতন হওয়া আর প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্র ‘প্রতিষ্ঠা’ হওয়া দুটো এক জিনিস না। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত হলো রাষ্ট্রের সকল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও কাঠামোর যথাযথ কার্যকারিতা। এক্ষেত্রে আন্তঃরাষ্ট্রীয় ভূ – রাজনীতির ভূমিকাও ব্যাপক। পররাষ্ট্র নীতির ফাঁক-ফোকর গলে অনেক সময় স্বার্থান্বেষী রাষ্ট্র কিংবা গোষ্ঠী  নিজেদের অস্ত্র-মাদক ব্যবসা কায়েম রাখতে ও বাহির থেকে আন্দোলন এবং আন্দোলন পরবর্তী সময় ‘ ফিয়ার মঙ্গারিং’ করে, কখনও ক্ষমতা দখলে বিদ্রোহীদের উস্কানি দিয়ে,কখনও বা নামজাদা কোনো স্বৈরশাসক কে অস্ত্রসহায়তা দিয়ে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখে, ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ চলা সত্ত্বেও পরাশক্তিগুলো অনেক সময় নীরব দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ইরাক যার জলজ্যান্ত প্রমাণ।  

বাংলাদেশে অনেক জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ৮ই আগস্ট শপথ গ্রহণ করে অন্তর্বর্তী সরকার। তাঁদের সামনে বহু চ্যালেঞ্জ। ভেঙে পড়া প্রশাসন,বিচারব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশন,অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান – সবকিছুর আমূল পরিবর্তন দরকার। তাছাড়া ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের গুরুত্ব বিবেচনায় পরাশক্তিদের সাথে ভারসাম্য রক্ষা,নিকট প্রতিবেশী ভারতের সাথে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বজায় রাখাও বড় চ্যালেঞ্জ।আওয়ামী লীগ বাদে দেশের অপর বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি সহ অন্যান্য বিরোধী দল কেমন পদক্ষেপ নেয়,এগুলোও মাথায় রাখা প্রয়োজন। অবস্থাদৃষ্টে পরিষ্কার যে,কঠিন পথই অতিক্রম করতে হবে ড. ইউনূস সরকারকে।

স্বৈরাচারের পতনের পর গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো শক্ত করা জরুরি। জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা , সুষ্ঠু ও স্বাধীন নির্বাচন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, বিচারবিভাগের স্বাধীনতা , দুর্নীতি ও দুঃশাসনমুক্ত নির্বাহী বিভাগ গঠন , গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ,  অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ বা প্রতিবিপ্লব রুখে দেয়া এবং সীমানায় সার্বভৌমত্ব রক্ষাই এখন ‘বাংলা বিপ্লব’ পরবর্তী অন্তর্বতী কালীন সরকারের মূল চ্যালেঞ্জ, যা আরব বিপ্লবে স্বৈরাচার পতনের পর সম্ভব হয়নি। ফলাফল- আরেক স্বৈরশাসন । বাংলাদেশও কি এই পথেই যাবে,নাকি বহু বছর পর আরেকবার গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হবে?  ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বতীকালীন সরকারের হাত ধরে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার  সেই স্বপ্নের দিকেই বোধ হয়  বাংলার মানুষ এগিয়ে চলেছে ; শহিদদের রক্তের ধারায় যে শ্রাবণে এই স্বপ্ন ছাত্রদের হাত ধরে বাংলায় এসেছে, আরবের মতো  ‘বসন্ত’ সেখানে না আসুক  ।।  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *